Monday, February 4, 2019

রাজধানীজুড়ে ভাইচক্রের ‘ভয়ঙ্কর ফাঁদ’, পা দিলেই সর্বনাশ!


প্রথমে ‘ভাই’। এরপর এলাকার মানুষ। কখনো আত্মীয়ের এলাকার। এরপর ছোট ছোট খোঁজ-খবর। আরো পরে একই এলাকার যাত্রী। বিভিন্ন সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি। এভাবেই আলাপ চলতে থাকে। একপর্যায়ে আস্থা অর্জন। হালকা আপ্যায়ন। আর এতেই ঘটে বিপত্তি। আস্থা অর্জন ও আপ্যায়ন করতে পারলেই তারা নেমে পড়ে কার্যসিদ্ধিতে। চোখের সামনেই ‘ভাই’য়ের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় সবকিছু। কিন্তু কিছুই বলার শক্তি থাকে না সব হারানো মানুষটির। সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মতোই দেখতে থাকেন তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়ার কাণ্ড। এ অবস্থায় আশপাশের মানুষেরও বোঝার উপায় থাকে না। তারা ভাবেন- মানুষগুলো তার পরিচিত। স্বেচ্ছায়-ই হস্তান্তর করছেন কাছের টাকা-পয়সা, জিনিসপত্র।

এভাবেই রাজধানীজুড়ে একটি 'ভাই চক্র' প্রতারণা চালিয়ে আসছে দিনের পর দিন। সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে টাকা-পয়সা-সোনা-দানাসহ মূল্যবান মালামাল। কোনো টার্গেট ব্যক্তির পেছনে সাধারণত ভাই চক্রের তিন সদস্য কাজ করে। একজন খাতির জমায়, ওই ব্যক্তির মাধ্যমেই কৌশলে কাছে আসে আরেকজন। আর তৃতীয়জন অধিকতর সতর্কতার জন্য দূর থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। কোনো কোনো চক্রে সদস্য সংখ্যা আরো বেশি থাকে। একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম কৌশলও তারা অবলম্বন করে। কখনো কখনো প্রতারণা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়েও।

রাজধানীজুড়ে একাধিক ‘ভাই চক্র’ প্রায় প্রতিদিনই মানুষকে প্রতারিত করে চলেছে। সম্প্রতি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এই চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের বিশেষ শাখা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর সদস্যরা। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি মো. আলমগীর মিয়া (২৮) চক্রের সক্রিয় সদস্য। তবে পলাতক রয়েছে চক্রের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য। তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পিবিআই। গত শুক্রবার (?) বিকালে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মহানগর পিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে ভয়ংকর সব তথ্য দেন আলমগীর। পরদিন শনিবার আদালতে দেয়া জবানবন্দিতেও সেসব কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।

জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তাদের একাধিক গ্রুপ রয়েছে। প্রত্যেক গ্রুপের এলাকাও নির্দিষ্ট রয়েছে। রেল স্টেশনে তারা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। এর বাইরে বিমানবন্দর, আব্দুল্লাহপুর, কুড়িল বিশ্বরোড, মহাখালী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, গাবতলী বাস টার্মিনালসহ জনবহুল এলাকায়। এছাড়া ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, লাকসাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরবসহ একাধিক শহরে তারা এই প্রতারণা করে আসছে।

সূত্র জানায়, পিরোজপুরের বাসিন্দা ঢাকার একটি সেলুনে কর্মরত মো. হাসান (২০) এ ব্যাপারে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন- তার ওমান প্রবাসী ফুফা সিফাত গত ২০শে ফেব্রুয়ারি শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে মালামাল পাঠিয়েছিলেন। ওইদিনই তিনি মালামালগুলো আনতে যান। ওই সময় তার কাছে ব্যাংকে জমা দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানের ২ লাখ ৩৬ হাজার টাকা এবং অফিসের কাজে ব্যবহৃত ল্যাপটপ, ৫টি মোবাইল, ৮টি পেন ড্রাইভ ছিল। ফ্লাইট আসতে দেরি হওয়ায় ১১টার দিকে তিনি বিমানবন্দর সংলগ্ন প্রধান সড়কের ফুটপাথে চা খাচ্ছিলেন। ওই সময় কবির নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরই মধ্যে সেখানে আলমগীর নামে আরেকজন হাজির হয়। কবির তাকে শ্যালক বলে পরিচয় করিয়ে দেয়।

আলমগীর তার ফেসবুক আইডিতে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়। তারাও শাহজালাল থেকে মালামাল গ্রহণ করতে এসেছে বলে জানায়। তার বাড়ি পিরোজপুর জানালে তারা জানায় তাদের বাড়ি ঝালকাঠি। এভাবে তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। বিমানবন্দর এলাকায় ঘুরাঘুরির একপর্যায়ে তারা গাড়ি পার্কিংয়ের ২য় তলায় যায়। এ সময় আলমগীর দুটি জুস এনে তার সামনেই কর্ক খুলে। সে নিজেই একটা খায়। অপর একটি জুস কবিরকে খেতে দেয়। কবির কিছুটা জুস খেয়ে হাসানকে দেয়। ওই জুস খাওয়ার পরই হাসানের মাথা চক্কর দেয়। ট্রলিতে বসেন তিনি। হাত-পায়ের শক্তি হারিয়ে যায়। কাউকে কিছু বলারও সার্মথ্য ছিল না তার।

তিনি দেখছিলেন, কবির এবং আলমগীর তার পকেটে থাকা ১০ হাজার টাকাসহ মানিব্যাগ, একটি স্যামসাং জে-৭ মোবাইল ফোনসেট, ব্যাগে থাকা ২ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ও একটি আসুস ল্যাপটপ, ৫টি বিভিন্ন ব্রান্ডের মোবাইল ফোনসেট, ৮টি পেন ড্রাইভ ও একটি ক্যানন ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে নিচ্ছে। যার সর্বমোট মূল্য অনুমান ৩ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। তিনি তখন অর্ধচেতন, তন্দ্রাচ্ছন্ন। এ অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে ২য় তলার সিঁড়ির কাছে এলে এক ব্যক্তি তাকে নিয়ে পুলিশ বক্সে যান। এ ঘটনায় হাসান বাদী হয়ে গত ২০শে মে বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটি বিমানবন্দর থানা থেকে পিবিআইয়ে হস্তান্তর হয়। তদন্ত করেন সংস্থাটির এসআই মো. জুয়েল মিঞা। তদন্তে অজ্ঞান পার্টির বিশালচক্রের সন্ধান মেলে।

পরে ঢাকা মহানগর পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদের দিকনির্দেশনায় অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মো. বশির আহমেদের নেতৃত্বে একটি দল অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রাম থেকে আলমগীর মিয়াকে (২৮) গ্রেপ্তার করে। এ সময় তার কাছ থেকে চোরাইকৃত ৩৫ হাজার টাকা, একটি মোবাইল সেট, একটি পেন ড্রাইভ এবং তার ব্যবহৃত ১টি মোবাইল উদ্ধার করে। আটককৃত আসামি জিজ্ঞাসাবাদে ভয়ঙ্কর তথ্য দেন। তিনি জানান, তার এই চক্রের মূল হোতা তাজুল ওরফে কবির ওরফে আলু। এছাড়া এই গ্রুপে আছে জাহিদ, ইংলিশ মাসুদ। এর মধ্যে ডিগ্রি পাস ইংলিশ মাসুদ ১৪ বছর ধরে এই কাজ করে। আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্বে রবিউল। ইংলিশ মাসুদ ছাড়াও তার গ্রুপে জনিসহ আরো অনেকেই কাজ করে।

পিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে ও আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে আলমগীর জানান, তাজুল ইসলাম ওরফে কবিরের নেতৃত্বে জাহিদ ও সে বয়ান (আলাপচারিতায়) দিয়ে সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে ভাই সম্পর্ক গড়ে তুলে। এরপর তার কাছে কি পরিমাণ টাকা আছে জানার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে তাদের চক্রের আরেক সদস্যকে কাছে ডেকে আত্মীয় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। বাকি সদস্যরা সাধারণ মানুষ হিসেবে নিকটবর্তী দূরত্বে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। কখনো কখনো নিজেদেরকে টার্গেট ‘ভাই’য়ের অঞ্চলের লোক বলে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে সখ্য গড়ে তোলে। এরই মধ্যে তাদের একজন উঠে গিয়ে জুস/কোল্ড ড্রিংস/ঝালমুড়ি/চানাচুর/চা/কফি নিয়ে আসে। টার্গেটের সামনেই একজন কোল্ড ড্রিংস এর কর্ক খুলে খেতে থাকে যাতে সন্দেহ না হয়। অপরজন কথা বলার ফাঁকেই অগোচরে আঙুলের ফাঁকে রাখা বিশেষ ঔষধ ডিসুপান-২ এর গুঁড়া করা মিশিয়ে দেয়। একজন খেয়ে দেয়ায় ভিকটিমের কোন সন্দেহ থাকে না। খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ভিকটিম তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে বসে পড়ে। তার সামনেই কাছে থাকারা সর্বস্ব লুটে নেয়। ভিকটিম দেখলেও দেখা ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকে না।
এ ছাড়াও চক্রটি বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে/রেল স্টেশনে ঘুরাফেরা করা একা থাকা যাত্রীকে টার্গেট করে। যাত্রী যে অঞ্চলে যাবে নিজেকে সে অঞ্চলের যাত্রী বলে পরিচয় দিয়ে পাশাপাশি বসে। অপরাপর সহযোগীরাও টিকিট নিয়ে বাসে যাত্রী হিসেবে ওঠে। যাত্রাপথে সুবিধামতো সময়ে বিশেষ ঔষধটি খাবারে মিশিয়ে যাত্রীর সর্বস্ব লুটে নেয়।

গ্রেপ্তারকৃত আলমগীর আরো জানান, কখনো তারা অল্প শিক্ষিত সহজ সরল যাত্রীকে টার্গেট করে। তাদেরকে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকে টাকা চুরি হয়েছে, সামনে চেক পোস্ট চলছে। টাকা থাকলে লুকিয়ে ফেলতে। তাদের কথায় বিশ্বাস করে যাত্রীর কাছে থাকা টাকা বের করে দিলে চক্রটি কাগজে মুড়িয়ে শার্ট/প্যান্টের ভাঁজে ভাঁজে রাখা বা লুঙ্গির কোঁচে রাখার কৌশল দেখিয়ে টাকার বদলে পূর্বে থেকেই মুড়িয়ে রাখা কাগজ দিয়ে টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। আবার এ চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন সরকারি অফিসের পিয়ন-ড্রাইভার পরিচয় দিয়ে যাত্রী সংগ্রহ করে থাকে। পরিচয়ের একপর্যায়ে ভিকটিমের গন্তব্যস্থান জেনে বলে আমার সাহেব-স্যারও ওখানে যাবে। আপনি চাইলে আমাদের গাড়িতে যেতে পারেন। এরই মধ্যে চক্রের আরেক সদস্য যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। তখন ড্রাইভার ছদ্মবেশি ওই চক্রের সদস্য বলে মালামাল থাকলে যাওয়া যাবে না। তাই স্যারের চোখ ফাঁকি দিতে সেগুলো তার কাছে দিতে বলে। একইসঙ্গে স্যারের সামনে টাকা নেয়া যাবে না বলেও কাগজে মুড়িয়ে দেয়ার কৌশল দেখাতে গিয়ে খালি কাগজ দিয়ে টাকা নিজের কাছে রেখে দেয়। পরে তাদেরকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে গাড়ি আনার কথা বলে উধাও হয়ে যায়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. জুয়েল মিঞা বলেন, এ চক্রের একাধিক সদস্যকে তারা চিহ্নিত করেছেন। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

খবর মানবজমিন। বাংলাদেশ সময়: ১০: ৫৮ ঘণ্টা, ৩০ মে ২০১৭ খ্রিঃ
(সংগৃহীত)

ভালো থাকুন | School of Awareness

No comments:

Post a Comment