ঢাকায় বিমানবন্দর সড়কের খিলক্ষেত থানা থেকে বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ি পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কারণে এই এলাকা ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার তৎপরতা থাকে সার্বক্ষণিক। কিন্তু এই ‘নিরাপত্তা বলয়ের’ মধ্যে সক্রিয় আছে আরেকটি ‘বাহিনী’। এই ‘ছিনতাই বাহিনী’র মূল লক্ষ্য বাইসাইকেল চালকেরা।
ভুক্তভোগী সাইকেল চালকেরা জানান, সন্ধ্যার পর ব্যস্ত এই সড়কে ঘটে ছিনতাইয়ের ঘটনা। তবে খিলক্ষেত বা বিমানবন্দর থানা কখনো ছিনতাইয়ের মামলা নিতে রাজি হয় না। কোনো ভুক্তভোগী সুনাগরিক হিসেবে থানায় গিয়ে হাজির হলে তাঁদের করতে হয় মালামাল খোয়ানোর জিডি। ছিনতাইয়ের পাশাপাশি রক্তাক্ত হামলার শিকার হলেও পুলিশ মামলা নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন অন্তত দুজন ভুক্তভোগী।
তবে পুলিশ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে তাদের বক্তব্যে দুই থানার ঠেলাঠেলির বিষয়ও বেরিয়ে এসেছে।
বিমানবন্দরের সামনে দিয়ে যাওয়া ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কটি মূলত গুলশান, বনানী ও মহাখালী এলাকার সঙ্গে উত্তরাকে যুক্ত করেছে। উত্তরা এবং এর আশপাশের এলাকার বাইসাইকেল চালকদের এ সড়ক ধরেই যাতায়াত করতে হয়। ছয় লেনবিশিষ্ট এই সড়কে সব সময় গাড়ি চলে দ্রুতগতিতে। অপেক্ষাকৃত কম গতির সাইকেল চালকেরা এমনিতেই ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করেন। এর সঙ্গে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য যুক্ত হওয়ায় সন্ধ্যার পর অনেকেই ওই সড়ক দিয়ে সাইকেল চালানো কমিয়ে দিয়েছেন।
ছিনতাইয়ের শিকার সাইকেল চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সন্ধ্যার পর পিঠে ব্যাগ বহনকারী চালকদের ওপরই মূলত ছিনতাইকারীরা হামলা চালায়। সংখ্যায় এরা সর্বোচ্চ ছয়জন পর্যন্ত থাকে।
গত ২২ নভেম্বর রাত আটটার দিকে ওই এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক ইউসুফ যুবায়ের। তিনি বলেন, অফিস শেষে প্রতিদিনকার মতো তিনি বাইসাইকেলে করে বাসায় ফিরছিলেন। হোটেল লা মেরিডিয়ান পার হওয়ার পরপরই ফুটপাতে দাঁড়ানো একটা ছেলে ‘ও ভাই কই যান’ বলে ফুটপাত থেকে লাফ দিয়ে তাঁর সাইকেলের সামনে এসে দাঁড়ায়। আরেকজন লাফ দেয় ঠিক তার ওপর। দুজনই মাটিতে পড়ে যায়। তখন তৃতীয় আরেকজন এসে তার গলায় ছুরি ধরে বলে, ‘যা আছে দিয়া দেন, কোনো ঝামেলার চেষ্টা কইরেন না।’ আরেকজন বলে, ‘ওর ব্যাগেই সবকিছু, নিয়ে নে।’
যুবায়ের বলেন, সাইক্লিস্টদের জার্সির পিঠের দিকে তিনটি পকেট থাকে। মুঠোফোনসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখার কাজে পকেটগুলো ব্যবহার করেন তাঁরা। সাধারণ মানুষদের বিষয়টি জানার কথা না। কিন্তু ওই ছিনতাইকারীরা ছিল অভিজ্ঞ। কাঁধের ব্যাগ নেওয়ার পর সরাসরি পিঠের ওই পকেটে হাত ঢুকিয়ে তাঁর মুঠোফোনটি নিয়ে নেয়। এরপর তারা দেয়াল টপকে বিমানবন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়ে। ঘটনার পরদিন খিলক্ষেত থানায় মামলা করতে গেলে ডিউটি অফিসার মামলা নেননি। হারানো জিনিসপত্রের সাধারণ ডায়েরি নিয়েছেন শুধু।
টঙ্গী থেকে খিলক্ষেত ফেরার পথে গত ফেব্রুয়ারিতে লা মেরিডিয়ানের উল্টো পাশে ছিনতাইয়ের শিকার হন নুমান খান নামের একজন ছাত্র। ছিনতাইকারীরা তাঁর গলায় ছুরি ধরে ব্যাগে থাকা ল্যাপটপ, ক্যামেরা ও কাগজপত্র নিয়ে যায়। তারা ইট দিয়ে তাঁর বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপরের অংশ থেঁতলে দেয়। নুমান খান প্রথম আলোকে বলেন, আধা ঘণ্টার মতো ফুটপাতের ওপর তিনি পড়ে ছিলেন। রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছিল, অনেকে জানালা দিয়ে তাকিয়েও দেখছিলেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি। এরপর আরেকজন বাইসাইকেলচালক ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে পড়ে থাকতে দেখে উদ্ধার করেন।
একই জায়গায় গত রমজান মাসে ইফতার শেষে ফেরার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হন কাব্য নুরুল মোমেন নামের আরেক বাইসাইকেলচালক।
ছিনতাইকারীদের বাঁশের আঘাতে দাঁত পড়ে গেছে আরেক সাইকেলচালক মো. এনামুল হকের। গত ১২ মার্চ খিলক্ষেত থানা থেকে কয়েক শ গজ দূরে লোটাস কামাল টাওয়ারের সামনে ছিনতাইয়ের শিকার হন বিমানবন্দরের এই সিএনএফ এজেন্ট। এনামুল বলেন, নিকুঞ্জ থেকে তিনি উত্তরার দিকে যাচ্ছিলেন। ছিনতাইকারীরা প্রথমে তাঁকে বাঁশ দিয়ে আঘাত করে রাস্তায় ফেলে দেয়। এরপর ইট দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করতে থাকে। তাঁর তিনটা দাঁত নড়ে যায় এবং একটা দাঁত পড়ে যায়।
সাইকেলচালকদের সংগঠন বিডি সাইক্লিস্টের একটি গ্রুপ আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। এই পেজে তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। বিমানবন্দর সড়কে বারবার ছিনতাইয়ের ঘটনাও সেখানে ভুক্তভোগী সাইকেলচালকেরা বিভিন্ন সময়ে তুলে ধরেছেন। ওই সড়ক দিয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার জন্যও বলেছেন অন্যদের।
পুলিশের কাছ থেকে প্রতিকার না পেয়ে বাইসাইকেলচালকদের কেউ কেউ আবার নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তার উদ্যোগ নিয়েছেন। পাল্টা আঘাতে ছিনতাইকারীর পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তৌসিফ বিন মোহাম্মদ নামে এক ইতালিপ্রবাসী সাইকেলে যাওয়ার পথে দুজন ছিনতাইকারীর আক্রমণের শিকার হন। তিনি আগে থেকেই হাতে রাখা তালা দিয়ে আঘাত করলে এক ছিনতাইকারী ঘায়েল হয় এবং পালিয়ে যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, খিলক্ষেত থানা থেকে বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ির মধ্যবর্তী তিন কিলোমিটার এলাকায় আরও দুটি পুলিশ বক্স আছে। মূল সড়ক থেকে একটু ভেতরে আছে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কার্যালয়। খিলক্ষেত থানা থেকে পাঁচ তারকা হোটেল লা মেরিডিয়ান পর্যন্ত মহাসড়কের পাশ দিয়ে একটি পার্শ্ব রাস্তাও আছে। মাঝখানে ফুটপাতের ওপর গাছগাছালি। সন্ধ্যার পর জায়গাটিতে আলোর স্বল্পতা দেখা দেয়। আর লা মেরিডিয়ানের পরপরই শুরু হয়েছে বিমানবন্দরের সংরক্ষিত এলাকার দেয়াল। দেয়ালের ভেতর দিয়ে একটি পার্শ্ব সড়ক বিমানবন্দরের ভিভিআইপি ও ভিআইপি টার্মিনালের গেট পর্যন্ত গেছে। জায়গাটি একেবারেই নির্জন। জলাশয়ও রয়েছে বেশ কয়েকটি।
গত রোববার আবুল বাহার নামের সেখানকার একটি নার্সারির কর্মচারী বলেন, ‘প্রায়ই ছিনতাইয়ের ঘটনার কথা শুনি।’ এত নিরাপত্তার মধ্যে কীভাবে ঘটনাগুলো ঘটে, তা নিয়ে তাঁরাও মাঝেমধ্যে আলোচনা করেন বলে জানান তিনি।
থানায় যাওয়া ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, জায়গাটি খিলক্ষেত ও বিমানবন্দর থানার মধ্যে পড়ায় কিছু ঘটলে কোনো থানাই দায়িত্ব নিতে চায় না। দুই থানাই বলে, ঘটনাস্থল তাদের থানার মধ্যে পড়ে না।
তবে সাইকেলচালকদের অভিযোগ মানতে নারাজ খিলক্ষেত থানার ওসি শহিদুল হক। তাঁর বক্তব্য, ‘দু-একটি ঘটনা ঘটে, তবে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নয়।’ তাঁর দাবি, অধিকাংশ ঘটনাই বিমানবন্দর থানা এলাকার মধ্যে ঘটে। তাঁর থানা এলাকায় দু-একটি ঘটনা ঘটে থাকলেও পুলিশের নিয়মিত টহলের কারণে তা কমে এসেছে। মামলা না নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, আইনি জটিলতার ভয়ে ভুক্তভোগীরাই মামলা করতে চান না।
আর বিমানবন্দর থানার ওসি নূরে আজম সোজা জবাব দিয়ে দিলেন, ‘আমার থানা এলাকায় এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি।’ ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, জিনিসপত্র খোয়ানোর যে জিডি তাঁদের দিয়ে করানো হয়েছে, তার কোনো অগ্রগতিও তাঁদের জানানো হয়নি। মোবাইলসহ মালামাল উদ্ধারে কোনো উদ্যোগ তাঁরা থানার কাছ থেকে পাননি।
বিডি সাইক্লিস্টের মডারেটর ফুয়াদ আহসান চৌধুরী বলেন, ‘ছিনতাইয়ের ঘটনায় বেশ কয়েকজন সাইকেলচালক আহত হওয়ায় কয়েক মাস আগে পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার এবং অতিরিক্ত উপকমিশনারের সঙ্গে আমরা দেখা করেছিলাম। তাঁরা খিলক্ষেত থানার ওসির সঙ্গে কথা বলে এই এলাকায় টহল বাড়িয়েছিলেন। তখন কিছুদিন পরিস্থিতি ভালো ছিল। কিন্তু আবারও আমরা সাইকেলচালকদের কাছ থেকে ছিনতাইয়ের অভিযোগ পাচ্ছি'।
(সংগৃহীত)
ভালো থাকুন | School of Awareness
No comments:
Post a Comment